দু’মুঠো আকাশ

জমির উদ্দিন সরকার একজন ভিতু প্রকৃতির মানুষ। গাজীপুরে তার কয়েকটা মিল ফ্যাক্টরি আছে। তার অধীনস্থ কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনশো। এতো বড় ব্যবসায়ী হয়েও তিনি একজন ভিতু মানুষ। টিকটিকি অথবা তেলাপোকা দেখলে তার ভিরমি খাওয়ার মতো অবস্থা হয়। গলা শুকিয়ে যায়। চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেন।

জমির সাহেব বাসা থেকে খুব একটা বের হন না। মহামারি করোনার কারণে তার এই বের না হওয়ার ব্যাপারটা স্বেচ্ছানির্বাসনের কাছাকাছি গিয়ে ঠেকেছে। তার ধারণা, বাসা থেকে বের হলেই তিনি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবেন। তাই বাসায় বসেই তিনি অফিসের কাজকর্ম করতে করেন।

সাত মাস আঠারো দিন পর তিনি আর বাসা থেকে বের না হয়ে পারলেন না। আড়াই কোটি টাকার একটা অর্ডার পাওয়ার জন্যে তদবির করতে হবে। সময় মতো লোকজনকে ধরাধরি করে তদবির করতে না পারলে অর্ডারটা হাত থেকে ফসকে যাবে। কাজেই বাধ্য হয়ে তাকে বাসা থেকে বের হতে হলো। প্রথমে তাকে একটা গার্মেন্টসে যেতে হবে। সেই গার্মেন্টসের মালিকের মাধ্যমে অর্ডারটা এসেছে। তার সঙ্গে বসে দর কষাকষি করে ঠিক করতে হবে কতো পার্সেন্টের বিনিময়ে তিনি অর্ডারটা নিয়ে দেবেন। সব ঠিক থাকলে অর্ডারের জন্যে আজকেই তাকে চট্টগ্রামে যেতে হবে। জমির সাহেব তার পরিচিত ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে কথা বলে রেখেছেন। তারা বিমানের টিকেটের ব্যবস্থা করে দেবে।

দুপুরের পর পর জমির সাহেব সেই গার্মেন্টসে গিয়ে পৌঁছলেন। চৌদ্দ তলা ভবনের সবচেয়ে উপরের তলায় মালিকের অফিস। জমির সাহেব লিফটে করে সোজা অফিসে চলে গেলেন। দরজার সামনে ছোট্ট একটা টেবিলের ওপাশে একটা মেয়ে উৎকট সাজগোজ করে বসে আছে। তার তীক্ষ্ণ চোখের বাঁকা চাহনি দেখলেই বোঝা যায় এই মেয়ে  চাইলে শুধু দৃষ্টিপাত করেই যেকোনো পুরুষের হৃদয়হরণ করতে পারে।

জমির সাহেবকে দেখে মেয়েটা হেসে বললো, স্যার আমি আপনাকে কী সহযোগিতা করতে পারি?

জমির সাহেব প্রতিউত্তরে স্মিত হেসে বললেন, আশুতোষ সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা করা কথা ছিলো।

মেয়েটা দ্রুত হাতে সাক্ষাৎসূচি দেখে নিয়ে বললো, স্যার, আপনার নাম কি জমির উদ্দিন সরকার?

জি।

বসুন। আশুতোষ স্যার এখনো আসেন নি।

জমির সাহেব ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। তিনি নিজেও কম বড় ব্যবসায়ী না। তারপরেও তাকে আরেকজন বড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে দেখা করার জন্যে অপেক্ষা করতে হয়।

মেয়েটা জমির সাহেবের দিকে তাকিয়ে মোহনীয় হাসির ছটা বিচ্ছুরণ করে ফোন তুলে নিলো। আশুতোষ সাহেবের সঙ্গে কথা বলে জমির উদ্দিন সাহেবকে বললো, স্যারের সঙ্গে কথা হয়েছে। স্যার আপনাকে বসতে বলেছেন। তিনি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এসে পড়বেন।

জমির সাহেব বললেন, আচ্ছা।

মেয়েটা তাকে অপেক্ষা-ঘরে বসিয়ে রেখে চলে গেলো। জমির সাহেব সোফায় বসে থেকেই পা লম্বা করে চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন।

চোখ বন্ধ করার পর কখন যে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন তা টেরই পেলেন না। আচমকা ভীষণ উত্তাপ টের পেয়ে তার ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুম ভাঙার পর তিনি কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে সোফায় বসে রইলেন। আশপাশ থেকে হুড়াহুড়ি আর চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। তাপটাও বাড়ছে। জমির সাহেব দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলেন সেই উৎকট সুন্দরী মেয়েটা যেদিকে বসেছিলো সেদিকটা লালচে হয়ে আছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় অস্তায়মান সূর্য যেন আকাশের বুকে তার অন্তিম লালিমা ছড়িয়ে দিয়েছে।

জমির সাহেব কব্জি ঘুরিয়ে হাতঘড়ি দেখলেন। ঠিক এমন সময় বিকট শব্দ করে ট্রান্সফর্মা বিস্ফোরিত হলো। জমির সাহেব আতংকে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। মুহূর্তের মধ্যে সব বাতি নিভে গেছে কিন্তু আলো কমেনি; বরং লালচে আলোটা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। তাপও বাড়ছে।

জমির সাহেব দ্রুত দরজা খুলে ঘর থেকে বের হয়ে হতভম্ব হয়ে দেখলেন অফিসের লোকজন যে যেদিকে পারছে ছুটছে। সবাই চিৎকার করছে। তাদের চিৎকার থেকে একটা শব্দই শোনা যাচ্ছে—আগুন! আগুন!!

জমির সাহেবের মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। মুহূর্তের মধ্যে তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। তার মনে হলো, এই মুহূর্তে তিনি এক সমুদ্র পানি এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেলতে পারবেন। জীবনে তিনি এই রকম ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হননি। তার চোখমুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। এই মুহূর্তে কী করা উচিত কিছুই বুঝতে পারছেন না। জমির সাহেব যাকে সামনে পেলেন তাকেই বলতে লাগলেন, আমাকে এখান থেকে বের হওয়ার ব্যবস্থা করে দিন। যতো টাকা চাইবেন ততো টাকা দেবো। জমির সাহেব ব্যাকুল হয়ে আবেদন করে গেলেন কিন্তু কেউ তার আবেদন শুনলো না। সবাই তার নিজের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত।

আগুনের বিস্তৃতি বাড়ছে। সেই সঙ্গে আটকে পড়া লোকজনের চিৎকার চেঁচামেচিও বাড়ছে। জমির সাহেব দিশাহারা হয়ে ছুটতে লাগলেন। ছুটতে ছুটতে তিনি একটা হলঘরের মধ্যে এসে পড়লেন। এখানে প্রচুর লোকের ভিড়। সবার চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে আছে। কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছে না কিন্তু সবাই কথা বলছে। কী বলছে তা তারা নিজেরাও জানে না।

জমির সাহেব এতোক্ষণে পোড়া গন্ধ পাওয়া শুরু করলেন। বিশ্রী গন্ধ। এমন বিশ্রী পোড়া গন্ধ তিনি ইহজীবনে পাননি। ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন বলে উঠলো, নিচের তলায় নিশ্চয়ই মানুষ পুড়ছে। এটা মানুষ-পোড়া গন্ধ। এই গন্ধ আমি চিনি। শ্মশানঘাটের বাতাসে এমন গন্ধ ভেসে বেড়ায়।

কথাটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে কান্নার শব্দ গুঞ্জরিত হতে লাগলো। জমির সাহেব এতোক্ষণে লক্ষ করলেন আটকে পড়া মানুষের মধ্যে কয়েকজন নারীও আছে। তারা চিৎকার করে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে। শুধু সেই রিসেপশনিস্ট মেয়েটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। এমনিতে মেয়েটার চেহারা গোলগাল কিন্তু এখন লম্বাটে দেখাচ্ছে। ভয় পাওয়ার কারণে বোধহয় এমন হয়েছে।

জমির সাহেব তার কাছে গিয়ে কাতর গলায় বললেন, এখন আমার কী হবে? আপনি আমাকে এখান থেকে বের হওয়ার ব্যবস্থা করে দিন। যতো টাকা চাইবেন ততো টাকা দেবো। দয়া করে আমাকে এখান থেকে বের হওয়ার ব্যবস্থা করে দিন।

জমির সাহেবের কথা শুনে মেয়েটা বিরক্ত গলায় বললো, সেই উপায় থাকলে আমি নিজেই আগে বের হতাম।

এখন কী হবে?

আমরা সবাই মারা যাবো। আগুনে পুড়ে বীভৎস ভাবে মারা যাবো। বাঁচার কোনো উপায় নেই।

জমির সাহেব ধপাস করে মাটিতে বসে পড়লেন। তার চোখের সামনে সালেহার চেহারা ভেসে উঠলো। সালেহার এখন কী হবে? বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তিনি তো ঘুণাক্ষরেও ধারণা করতে পারেন নি সালেহার সঙ্গে এটাই তার শেষ দেখা। আর কোনোদিন সালেহার সঙ্গে দেখা হবে না। বিয়ের তিন বছর পর তাদের একটা মেয়ে সন্তান হয়েছিলো। জন্মের আট মাস পর সেই সন্তান মারা যায়। এরপর সতেরো বছর পার হয়েছে কিন্তু তাদের আর কোনো সন্তান হয়নি। সালেহা এখনো সেই মৃত সন্তানের কথা মনে করে কাঁদে। মধ্যরাতে তার ঘুম ভাঙিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে একটু সান্ত্বনা দাও। তিনি মারা গেলে সালেহার কী হবে? সে কাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা খুঁজবে?

জমির সাহেবের চোখ ভিজে গেলো। এই তলায়ও আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। আসন্ন মৃত্যুর আতংকে সবাই পাগলের মতো চিৎকার করে কাঁদছে। সবাই নিজের মতো করে ঈশ্বরকে ডাকছে। জমির সাহেব চিৎকার চেঁচামেচি করলেন না। চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালেন। এখন সেই রিসেপশনিস্ট মেয়েটাও চিৎকার করে কাঁদছে। জমির সাহেব তার মাথার হাত রেখে বললেন, মা, আমার মেয়েটা বেঁচে থাকলে সে তোমার বয়সী হতো। ভালো থাকো।

রিসেপশনিস্ট মেয়েটা কিছুই বুঝতে পারলো না। কাঁদতে কাঁদতে বিরক্ত হয়ে জমির সাহেবের হাত সরিয়ে দিলো। জমির সাহেব কিছু বললেন না। মেয়েটার দিকে কয়েক মুহূর্ত গভীর স্নেহের চোখে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ধীর পায়ে হেঁটে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালেন। জানালার ওপাশের মুক্ত আকাশ কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে। নিচের রাস্তায় মানুষের ভিড়। ভিড়ের মধ্যে অনেকের হাতে মোবাইল। তারা ভিডিও করছে। ভিড়ের কারণে দমকল বাহিনীর গাড়ি এগুতে পারছে না। চৌদ্দ তলার উপর থেকে নিচের সব কিছুকে ক্ষুদ্র এবং তুচ্ছ মনে হচ্ছে। জমির সাহেব জানালা দিয়ে দুই হাত বাড়িয়ে দিলেন। তিনি জানেন জানালা দিয়ে বের হয়ে আগুন থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। তারপরেও তিনি জানালা দিয়ে দুই হাত বের করে দিলেন। তিনি বের হতে না পারলেও হাত দুইটা তো বের করতে পেরেছেন। ফলে হাত দুইটা হয়তো একটু দেরিতে পুড়বে!

পেছন থেকে ভীষণ ভয়ার্ত চিৎকার শোনা যাচ্ছে। বাতাসে জীবন্ত মানুষ পোড়ার তীব্র গন্ধ। সেই রিসেপশনিস্ট মেয়েটা চিৎকার করছে—আমাকে বাঁচাও! আমাকে বাঁচাও!! আমি আগুনে পুড়ে গেলাম!!!

জমির সাহেবের একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতে ইচ্ছা করলো কিন্তু তিনি তাকালেন না। জালানার এপাশ থেকে দুই হাত মেলে স্থির চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

˜™

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *